ইসমাইল হোসেন, সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধিঃ
৫ বছর পর ক্লুলেস রহস্য উদঘাটন করেছে সিরাজগঞ্জ পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। নিহত বিউটি খাতুন জেলার এনায়েতপুর থানার ব্রাহ্মণগ্রাম গ্রামের মো. সাচ্চু মিয়ার মেয়ে।
এই ঘটনায় সাচ্চু মিয়া বাদী হয়ে ২০১৮ সালের ১৪ই মে এনায়েতপুর থানায় অজ্ঞাতনামা আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। এই হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত থাকায় ৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
গ্রেপ্তাকৃতরা হলো-এনায়েতপুর থানার ব্রাহ্মণগ্রামের মৃত আমির হোসেনের ছেলে স্বপন ব্যাপারী (৩৭), মৃত জসিম উদ্দিনের ছেলে মো. মমিন (৫৫), মমিনের স্ত্রী আনু বেগম (৪০) ও ২০২১ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা থেকে আব্দুর রাজ্জাকের ছেলে ওমর ফারুক (২৮) কে গ্রেপ্তার করা হয়।
সোমবার (২৯ মে) দুপুরে প্রেস ব্রিফিং এর মাধ্যমে এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন সিরাজগঞ্জ পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেষ্টিগেশন (পিবিআই) এর পুলিশ সুপার মো. রেজাউল করিম।
প্রেস ব্রিফিং এর পুলিশ সুপার মো. রেজাউল করিম বলেন, ২০১৮ সালের ১৩ই মে রাতে বিউটি খাতুন তার নিজ ঘরে ঘুমিয়ে পড়েন। এসময় বিউটির মা কোমেলা খাতুন প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে দেখেন তার মেয়ের ঘরের দরজা খোলা। সেই সময় বিউটিকে ডাকলে কোন সাড়া-শব্দ না করায় বিউটির ঘরে যান মা। বিউটির শরীরে হাত দিয়ে ডাকাডাকি করেন। পরে চিৎকার দিলে বিউটির পরিবারের সদস্যরা ঘরের আলো জ্বালিয়ে দেখেন- বিউটি মৃত অবস্থায় পড়ে আছেন। পরিবারের লোকজনের চিৎকারে স্থানীয় লোকজন ঘটনাস্থলে এসে থানা পুলিশকে খবর দেয়। পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে মৃতদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য হাসপাতালে পাঠায়।
পরে বিউটির বাবা সাচ্চু মিয়া বাদী হয়ে এনায়েতপুর থানায় অজ্ঞাতনামা আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
মামলাটি থানা পুলিশের পাশাপাশি সিরাজগঞ্জ পিবিআই তদন্ত করতে থাকে। মামলাটি তদন্তের প্রায় ২ বছর পরে বাদীর আবেদনের প্রেক্ষিতে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স, ঢাকা মামলাটি পিবিআইকে তদন্ত করার জন্য নির্দেশ প্রদান করেন। পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স, ঢাকা এর নির্দেশে সিরাজগঞ্জ পিবিআই মামলাটির তদন্ত শুরু করে। দীর্ঘদিন তদন্তের এক পর্যায়ে গত ২০২১ সালের ১৬ই ফেব্রুয়ারি ঢাকা থেকে আব্দুর রাজ্জাকের ছেলে ওমর ফারুক (২৮) কে গ্রেপ্তার করা হয়। তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় চলতি বছরের ২৩ ও ২৫ মে রাতে সন্দেহমূলক ৩ জনকে আটক করা হয়। পরে গ্রেপ্তারকৃতরা হত্যার সাথে জড়িত থাকায় আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেয়।
পুলিশ সুপার আরও জানান, ২০১৪ সালে এনায়েতপুরের কোচগাঁও গ্রামের আব্দুল্লাহর সাথে বিউটি খাতুনের বিয়ে হয়। বিয়ের ৩ বছর পরে স্বামীর সঙ্গে তালাক হয় তার। বাবার বাড়িতে থাকাবস্থায় প্রতিবেশী ওমর ফারুকের সঙ্গে মোবাইলে কথা হতো বিউটির। একপর্যায়ে ফারুক বিউটিকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। ফারুকের সেই প্রস্তাব প্রত্যাখান করে বিউটি,।
ওদিকে বিউটির ছোট বোন আলোমতির স্বামীর পরিবারের সাথে ঝামেলা হয়। পরে বিউটির বাবা সাচ্চু মিয়া তাদের পার্শ্ববর্তী গ্রামের স্বপন ব্যাপারীকে বিষয়টি সমাধান করার জন্য অনুরোধ করে। স্বপনের মাধ্যমে বিউটির ছোট বোন আলোমতির স্বামীর বাড়ীর সমস্যার সমাধান হওয়ায় বিউটির পরিবারের সাথে স্বপনের সু-সম্পর্ক তৈরি হয়। বিউটির ছোট খালা আন্না মাদক ব্যবসা করায় সে বিউটির মোবাইল দিয়ে স্বপনের সাথে মাঝে-মধ্যে কথা বলত।,
অপরদিকে স্বপন মাদকসেবী হওয়ায় মাঝে মধ্যে স্বপন আন্নার বাড়িতে যাওয়া আসা করত এবং মাদক সেবন করত। সেই সুবাদে বিউটির সাথেও স্বপনের দেখা সাক্ষাৎ হত এবং মোবাইলে কথাবার্তা হত। স্বপন, বিউটির সাথে প্রেমের সম্পর্ক স্থাপন করার চেষ্টা করত। কিন্তু স্বপন সরাসরি বিউটিকে প্রস্তাব দিতে না পেরে আন্নাকে জানায়। পরবর্তীতে স্বপন আন্নার মাধ্যমে বিউটির সাথে প্রেমের সম্পর্ক স্থাপন করে। বিউটির ছোট খালা আন্নার মাধ্যমে আন্নার বাড়ীতে স্বপন নিয়মিত বিউটির সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করত।,
একপর্যায়ে বিউটির বাবা সাচ্চু মিয়া স্বপনকে জানায়, তার প্রতিবেশী ওমর ফারুক বিউটিকে ডিস্টার্ব করে তাকে একটু শাসন করে দিতে হবে। স্বপন এলাকায় প্রভাবশালী হওয়ায় সে ওমর ফারুককে শাসন করে। বিউটির সাথে স্বপনের অনুমান ২ মাস সম্পর্ক চলার পরে বিউটিকে বিয়ে করার জন্য স্বপনকে চাপ দেয়। স্বপন বিবাহিত হওয়ায় বিউটিকে বিয়ে করতে রাজি না হলে বিউটি স্বপনকে জানায়, সে অন্তঃসত্ত্বা।
পরবর্তীতে বিউটি স্বপনের উপর আরো বেশি চাপ সৃষ্টি করলে স্বপন কি করবে তা ভেবে না পেয়ে ঘটনার ১০-১২ দিন আগে প্রতিবেশী ওমর ফারুককে ডেকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে।
স্বপন বিউটিকে হত্যা করার পরিকল্পনা করে এবং ওমর ফারুককে স্বপনের সাথে থাকতে বলে। কিন্তু ওমর ফারুক রাজি না হলে স্বপন ওমর ফারুককে ভয়-ভীতি দেখায়। স্বপন বিউটির সাথে ওমর ফারুকের পূর্বের সম্পর্কের বিষয় দিয়ে ব্ল্যাকমেইল করে হত্যার পরিকল্পনায় সাথে নেয়।
পরে স্বপন বিউটির ছোটখালা আন্নার কাছে বিউটিকে হত্যা করার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু আন্না তার নিজের ভাগ্নীকে হত্যা করতে রাজি না হলে স্বপন তাকে টাকার লোভ দেখিয়ে রাজি করায়। পরে ৫০ হাজার টাকার বিনিময়ে আন্নাকে দিতে চায়। তাৎক্ষণিক স্বপন ২০ হাজার টাকা ওমর ফারুককে ও ৩০ হাজার টাকা দেয় আন্নাকে। তখন বিউটির ছোট খালা তার আপন মেজো বোন আনু বেগমকে ২০ হাজার টাকা দিয়ে বিউটিকে হত্যা করতে সহায়তা করতে বলে। আনু বেগম তার স্বামী মোমিন এর সাথে কথা বলে তাকে রাজি করায়। তাদের পূর্বপরিকল্পনা মোতাবেক গত ১৩ই মে ২০১৮ সালে রাত সাড়ে ১১টার দিকে বিউটিদের বাড়ির পাশে সবাই একত্র হয়। পরে স্বপন, ওমর ফারুক, আনু, আন্না ও মোমিন বিউটির ঘরে ঢুকে ঘুমন্ত অবস্থা বিউটিকে হাত-পা ও মাথা চেপে ধরে মুখে বালিশ চাপা দিয়ে হত্যা করে কৌশলে পালিয়ে যায় ।
গত ২৬/০৫/২০২৩ খ্রিঃ আসামীরা নিজেদের দোষ স্বীকার করে বিজ্ঞ আদালতে ফৌঃ কাঃ বিঃ ১৬৪ ধারা মোতাবেক স্বীকারোক্তি মূলক জবানবন্দি প্রদান করে।
আপনার মতামত লিখুন :